The Rainbow
William Wordsworth
My heart leaps up when I behold
A Rainbow in the sky:
So was it when my life began;
So is it now I am a man;
So be it when I shall grow old,
Or let me die!
The Child is father of the man;
And I could wish my days to be
Labels: ভাললাগে
I wandered lonely as a cloud
That floats on high o'er vales and hills,
When all at once I saw a crowd,
A host, of golden daffodils;
Beside the lake, beneath the trees,
Fluttering and dancing in the breeze.
Continuous as the stars that shine
And twinkle on the milky way,
They stretched in never-ending line
Along the margin of a bay:
Ten thousand saw I at a glance,
Tossing their heads in sprightly dance.
The waves beside them danced; but they
Out-did the sparkling waves in glee:
A poet could not but be gay,
In such a jocund company:
I gazed---and gazed---but little thought
What wealth the show to me had brought:
For oft, when on my couch I lie
In vacant or in pensive mood,
They flash upon that inward eye
Which is the bliss of solitude;
And then my heart with pleasure fills,
And dances with the daffodils.
William Wordsworth
Labels: ভাললাগে
Labels: ভাললাগে
Labels: ভাললাগে
Ankhon se door hone ka koi gila nahi
Dil ke bouhat qarib ho kuch fasila nahi
Yaad rakho to dil ke paas hoon main
bhool jao to fasile hain bouhat
Mita do naam tak mera kitabe zindagi se tum
Magar pal pal roolayegi stayegi kami meriAgar maloom hota muhabbat ka anjam pahle se
...........................
Na dil diya hota na jaan diya hota
Kuch tuhi mere dard ka mafhoom samajh le
Hasta hua chehra zamane ke liye hai
Mana ki muhabbat ka izhar nahi karte
Tum ye na samajh lena ki ham peyar nahi karte
Dil me basai thi tasvir mita dena
.............................
Aankhon me basaya tha nazron me gira dena
Tum ko to wafa meri kuch raas na aai
Jati hoon tere dar se mujhko na sada dena
Jab tum se koi pooche baaten meri wafaon ki
Tum meri wafaon par ilzam laga dena
Fir oski tamanna keya jo gair ka ho jaye
Bas itni guzarish hai tum mujhko bhula dena
.........................
Mana ki muhabbat ka izhar nahi karte
Tum ye na samajh lena ki ham peyar nahi karte
Door bhaga na karo shoq gazalon ki tarah
Ham ne chaha hai tumhe chahne walon ki tarah
Shama ummid ki is dil me jlayen kaise
Apni muhbbat ka eqin dilayen kaise
Labels: ভাললাগে
আমি কবি– সেই কবি–
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!
স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা–
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!
ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,–
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!
বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প’ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!
যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ’লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক’রে চলে;
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে
সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ
তা’হলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়
দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে;
যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ
আচ্ছন্ন মাছির মত মরে -
তবুও একটি নারী ‘ভোরের নদীর
জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে’
এ রকম দু-চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা
ভেবে শেষ হ’য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে।
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে
পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান,
কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।
কতদিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর
খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে; — সন্ধ্যার ধূসর সজল
মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে — বাদুড় কেবল
করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে — ছিন্ন ভিজে খড়
বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন পড়ে আছে নরম প্রান্তর;
বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে — কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল
নিঃশব্দ গুবরে পোকা — সাপমাসী — ধানী শ্যামাপোকাদের দল;
দিকে দিকে চালধোয়া গন্ধ মৃদু — ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বর
শোনা যায় — মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে — খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি
কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি বুঝেছি এই সব;
সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি
খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি
ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি এইসব।
ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর — চিল একা নদীটির পাশে
জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে;
পায়রা গিয়েছে উড়ে তবু চরে, খোপে তার; — শসাতাটিকে,
ছেড়ে গেছে মৌমাছি; — কালো মঘে জমিয়াছে মাঘের আকাশে,
মরা প্রজাতিটির পাখার নরম রেণু ফেলে দিয়ে ঘাসে
পিঁপড়েরা চলে যায়; — দুই দন্ড আম গাছে শালিখে — শালিখে
ঝুটোপুটি, কোলাহল — বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে
ডাকে নাকো-হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালে পলাশে
হারায়েছে; বউ উঠানে নাই — প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি;
ধান কে কুটবে বলো-কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান,
রোদেও শুকাতে সে যে আসে নাকো চুল তার — করে নাকে স্নান
এ-পুকুরে — ভাঁড়ারে ধানের বীজ কলায়ে গিয়েছে তার দেখি,
তবুও সে আসে নাকে; আজ এ দুপুরে এসে খই ভাজিবে কি?
হে চিল, সোনালি চিল, রাঙা রাজকন্যা আর পাবে না কি প্রাণ?
মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন,
শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;
সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তার
জানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না…
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না-
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস
নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?
মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে — হাসির আস্বাদ
পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে কড়ির মতন শাদা মেঘের পাহাড়ে
সূর্যের রাঙা ঘোড়া; পক্ষিরাজের মতো কমলা রঙের পাখা ঝাড়ে
রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ
উঠেছে আনন্দে জেগে — নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ
চলে গেছে কলরবে; — দেখেছি সবুজ ঘাস — যত দূর চোখ যেতে পারে;
ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল, — পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে
ঢেকে আছে; — দেখিয়াছি বাসমতী, কাশবন আকাঙ্খার রক্ত, অপরাধ
মুছায়ে দিতেছে যেন বার বার কোন এক রহস্যের কুয়াশার থেকে
যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে
রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে
আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু — আমাদের বিস্মিত নীরব
রেখে দেয় — পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আচঁড় ঢের, অশ্রু গেছি রেখে
তবু ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।
যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে
কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে –
দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে –
তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার- তাহাদের ছায়া যে পড়িছে
আমার বুকের পরে — আমার মুখের পরে নীরবে ঝরিছে
খয়েরী অশথপাতাত — বইচি, শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে,
নিবিড় হয়েছে তাই আমার চিতার ছাইয়ে — বাংলার ঘাসে
গভীর ঘাসের গুচ্ছে রয়েছি ঘুমায়ে আমি, — নক্ষত্র নড়িছে
আকাশের থেকে দূর-আরো দূর-আরো দূর-নির্জন আকাশে
বাংলার-তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে।
আবার যখন জাগি, আমা শ্মশানচিতা বাংলার ঘাসে
ভরে আছে, চেয়ে দেখি,-বাসকের গন্ধ পাই-আনারস ফুলে
ভোমরা উড়িছে,শুনি-গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে
রোদের দুপুর ভরে-শুনি আমি; ইহারা আমার ভালোবাসে-
যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,
তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান-
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান-
পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস করে হৃদয়ের নরম কাতর
অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন
কাটায়েছি; বনে বনে ডালপালা উড়িতেছে — যেন পরী জিন্
কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের পর
খইয়ের ধানের মতো দেখিয়াছি ঝরে ঝর্ ঝর
দু-ফোটা মেঘের বৃষ্টি, — শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন,
ম্লান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে… গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ
অস্ফুট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর:
এই সব দেখিয়াছি; — দেখিয়াছি নদীটিরে — মজিতেছে ঢালু অন্ধকারে;
সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অম্বনে’র নীড়ের ভিতর
পাখনার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে
কে যেন দাঁড়ায়ে আছে: আরো দূরে দু একটা স — ব্দ খোড়ো ঘর
পড়ে আছে; — খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন — থামিতে কি পারে;
‘তুমি কেন এইখানে’, ‘তুমি কেন এইখানে’ — শরের বনের থেকে দেয় সে উত্তর।
(আবার পাখনা নাড়ে — কাকের তরুন ডিম পিছলায়ে পড়ে যায় শ্যাওয়ার ঝাড়ে)
পাড়াগাঁর দু পহর ভালোবাসি — রৌদ্র যেন গন্ধ লেগে আছে
স্বপনের; — কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো — কেবল প্রান্তর
জানে তাহা, আর ওই প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে
যেন এ-জনমে নয় — যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে
এ — হৃদয় — স্বপ্নে যে বেদনা আছে : শুষ্ক পাতা — শালিখের স্বর,
ভাঙা মঠ — নক্শাপেড়ে শাড়িখানা মেযেটির রৌদ্রের ভিতর
হলুদ পাতার মতো স’রে যায়, জলসিড়িটির পাশে ঘাসে
শাখাগুলো নুয়ে আছে বহু দিন ছন্দহীন বুনো চালতার:
জলে তার মুখখানা দেখা যায় — ডিঙিও ভাসিছে কার জলে,
মালিক কোথাও নাই, কোনোদিন এই দিকে আসিবেনা আর,
ঝাঁঝরা ফোঁপরা, আহা ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে;
পাড়াগাঁর দু — পহর ভালোবাসি — রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার
গন্ধ লেগে আছে, আহা, কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে।
তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, - কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান
একদিন; - হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে -
হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে
নীল, মৃত্যু উজাগর - বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ -
কখন মরণ আসে কে বা জানে - কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাম ভাঙে - ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ
জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ - ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনায় নয় - যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখে মুখে - রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও — আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে-একবার — দুইবার — তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ — শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে,
খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন্ কাহিনীর দেশে –
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীরে –
নীরবে পা ধোয় জলে একবার — তারপর দূরে নিরুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায় — তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি — সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
তুমি কেন বহু দূরে — ঢের দূর — আরো দূরে — নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ
তুমি কেন কোনদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বলো নাকো একটিও কথা;
আমরা মিনার গড়ি — ভেঙে পড়ে দুদিনেই — স্বপনের ডানা ছিড়ে ব্যথা
রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে — ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয় — নীল নাভিশ্বাস;
ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড যুগ থেকে আজো বারোমাস;
আমাদের সত্য, আহা রক্ত হযে ঝরে শুধু; — আমাদের প্রাণের মমতা
ফড়িঙের ডানা নিয়ে ওড়ে, আহা: চেয়ে দেখে অন্ধকার কঠিন ক্ষমতা
ক্ষমাহীন — বার বার পথ আটকায়ে ফেলে বার বার করে তারে গ্রাস;
তারপর চোখ তুলে দেখি ঐ কোন দূর নক্ষত্রের ক্লান্ত আয়োজন
ক্লানি — র ভুলিতে বলে — ঘিয়ের সোনার দীপে লাল নীল শিখা
জ্বলিতেছে যেন দূর রহস্যের কুয়াশায়, — আবার স্বপ্নের গন্ধে মন
কেঁদে ওঠে — তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু ক্লানি — রক্তের কণিকা
ঝরে শুধু — স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ — নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা?
স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরিয়া, উজ্জায়িনী, গৌড় বাংলা, দিল্লী, বেবিলন?
তবু তাহা ভুল জানি — রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা:
তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ় —
আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জল আরো;
তোমারো পৃথিবী পথ; নক্ষত্রের সাথে তুমি খেলিতেছ পাশা:
শঙ্খমালা নয় শুধু: অনুরাধা রোহিনীর ও চাও ভালোবাসা,
না জানি সে কতো আশা — কতো ভালোবাসা তুমি বাসিতে যে পার!
এখানে নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো ঝরিছে আবাো;
প্রান্তরের কুয়াশায় এখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা —
এসেছে সন্ধ্যার কাক ঘরে ফিরে, — দাঁড়ায়ে রয়েছে জীর্ণ মঠ,
মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে — লালপেড়ে পুরানো শাড়ির
ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে — কে এসেছে আমার নিকট?
কার শিশু? বলো তুমি: শুধালাম, উত্তর দিলো না কিছু বটে;
কেউ নাই কোনোদিকে — মাঠে পথে কুয়াশার ভিড়;
তোমারে শুধাই কবি: তুমিও কি জানো কিছু এই শিশুটির।
জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে - আর এই বাংলার ঘাস
র’বে বুকে; এই ঘাস:সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়-
ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়-
এই ঘাস:এরি নিচে কস্কাবতী শঙ্খশালা করিতেছে বাস:
তাদের দেহের গন্ধ,চাঁপা ফুল-মাখা স্নান চুলের বিন্যাস
ঘাস আজো ঢেকে আছে : যখন হেমন- আসে গৌড় বাংলায়
কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায়
ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস,
আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি - শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে
নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে
সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে- কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে
ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে - শাদা দুধ ঝরে
করবীর : কোন্ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল,
তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে - ঘাসে : নরম ব্যাকুল।
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার
ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে
কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি-কবে যেন রাখিয়াছে হাতে
তার হাতে- কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড়
ঝরে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন-এই পাড়াগাঁর
পথে তবু তিন শো বছর আগে হয়তো বা- আমি তার সাথে
কাটায়েছি; পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা — সাতশো বছর
কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে;
ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে-মাঠে কতোবার কুড়ালাম খড়;
বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে,
ভাসানের গান গুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে
মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খর আর ঘর।
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা — আমার তরুণ দিন
তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো — ঘুম আসে-বাংলার তৃণ
আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে
কাঁচপোকা ঘুমায়েছে — আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে,
ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে — এই ঘাসে — কথাভাষাহীন
আমার প্রাণের গল্প ধীরে-ধীরে যাবে-অনেক নবীন
নতুন উৎসব রবে উজানের-জীবনের মধুর আঘাতে
তোমাদের ব্যস্ত মনে; — তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে
যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে — যখন মানিকমালা ভোরে
লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে–
যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে
ঝরিয়ে ঘাসের পরে, — শালিখ খঞ্জনা আজ কতো দূরে ওড়ে–
কতোখানি রোদ-মেঘ — টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে।
ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর –
সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে — তাই নীলাকাশ
মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়; — পথে পথে তাই এই ঘাস
জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়, — কউমাছিদের যেন নীড়
এই ঘাস; — যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর
নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস
কথা কয় — তাহাদের শান — হাত খেলা করে — তাদের খোঁপায় এলো ফাঁস
খুলে যায় — ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা — অনেক নিবিড়
পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায় — হৃদয়ের বেদনার কথা –
সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা — মাঠের চাঁদের গল্প করে –
আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়; — শিশিরের শীত সরলতা
তাহাদের ভালো লাগে, — কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে;
গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে — পেঁচার নম্রতা;
ভালো লাগে এই যে অশ্বথ পাতা আমপাতা সারারাত ঝরে।
গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়
উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে;
পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার-বার চায় সে জড়াতে
করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়;
এক-একটি ইট ধ্বসে-ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায়
ভাঙা ঘাটলায় এই-আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে
বিনুনি খসায় নাকো-শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে;
কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়;
ডাইনীর মতো হাত তুলে-তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন
বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো, -বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে
পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নই আমি, হায়, এমন বিজন
শাদা পথ-সোঁদা পথ-বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে
চলে গেছে শ্মশানের পারে বুঝি;-সন্ধ্যা সহসা কখন;
সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে।
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!
Labels: Collections
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
ভেবে ভেবে ব্যথা পাব: মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে
দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি –
এমনি লাজুক পাখি, — ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে;
যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি?
শিউলির বাবলার আঁধার গলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো
করে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোটো — ছোঁটো ছেলেমেয়ে বউদের প্রাণ
ভুলে যায়; অন্ধকার খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারালো
মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার জানে না সন্ধ্যান।
আর সেই সোনালি চিলের ডানা — ডানা তার আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে; — সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজও চ’লে যায় সন্ধ্যা
সোনার মত হলে?
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
আশ্চর্য বিষ্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধাকার বিছানার কোলে।
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে
আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না ক িজামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে –
সন্ধ্যা হয় — চারিদিকে মৃদু নীরবতা
কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে;
গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেড়ে ধীরে ধীরে;
আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে;
পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু;জনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
(এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, — আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –
এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,
পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে
ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,
নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –
পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেষে
কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;
তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে
মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;
তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;
পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;
কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।
নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো
কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’
ঘাসের ভিতরে সেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে — আমি ভালোবাসি
নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই — কবে যেন ভেঙেছিল — ঢের ধুলো খড়
লেগে আছে বুকে তার — বহুক্ষণ চেয়ে থাকি; — তারপর ঘাসের ভিতর
শাদা শাদা ধুলোগুলো পড়ে আছে, দেখা যায় খইধান দেখি একরাশি
ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষন্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি;
কান পেতে থাকি যদি, শোনা যায়, সরপুটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর
মীনকন্যাদের মতো, সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর
দেখা যায় — রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ — রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসী
চলে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল ছেলের মতো রাজার ছেলের মতো মিলে
কোন এক আকাঙ্খার উদঘাটনে কত দূরে; বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা
অপরাহ্ন এল বুঝি? — রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায় — ডানা ঝিলমিলে;
এক্ষুনি আসিবে সন্ধ্যা, — পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে
নদীর নরম মুখ দেখা যাবে — মুখে তার দেহে তার কতো মৃদু রেখা
তোমারি মুখের মতো: তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা।
আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক — পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, — চলে গেল কবে যে নীরবে,
তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি নাকো — কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে,
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা করে গেছে তারা কত দিন — ফড়িঙ কীটের দিন যত দিন চলে
তাহারা নিকটে ছিলো — রোদের আনন্দে মেতে — অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে
বহুদিন কাছে ছিলো; — অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে
তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ — মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে;
কোথায় গিয়েছে তারা? ওই দূর আকাশেল নীল লাল তারার ভিতরে
অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু — ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?
শুধালাম — উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায়
জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন;
বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাংচিল শালিখের মতন স্বাধীন;
বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার;
একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার
বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে — নীল ধোঁয়া নরম মলিন
বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ;
ফেনসা ভাতের গন্ধে আম — মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার — বার;
এই সব দেখেছিল রূপ যেই স্বপ্ন আনে — স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে,
শিখেছিল, সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে;
তারপর বেত বনে, জোনাকি ঝিঝির পথে হিজল আমের অন্ধকারে
ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে করে, — রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে –
ঘুমন — কন্যারে সেই — জাগাতে যায়নি আর — হয়তো সে কন্যার হৃদয়
শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো — ঘুম তবু ভাঙিবার নয়।
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে;
সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন
রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন;
ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে
মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে,
নির্জন আমের ডালে দুলে যায় — দুলে যায় — বাতাসের সাথে বহুক্ষণ,
শুধু কথা, গান নয় — নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন
বুঝিয়াছি; শুপুরীর সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে নড়ে,
দিনরাত কথা নয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব
ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী মরে গেছে — দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে
তবু ওই পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসে
আম নিম জামরুলে; প্রসন্ন প্রাণের স্রোত — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই কিছু,
ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু,
চেয়ে দেখি ঘুম নাই — অশ্রু নাই — প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ মাখা ঘাসে।
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান
রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট ম্লান
একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার,
নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক নবীনাগতার
মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান
এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান,
প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যায় –
চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে,
প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন
রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায় কাঁটায় যেইখানে
মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে গভীর শিহরণ,
তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের ম্লানে
জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে রবে, বাঁচিতে সে জানে।
Labels: Collections
১৯৪০
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।
অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো–
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো।
অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।
হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত–’রক্ত খরচ’ তাতে।
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!
১৯৪৬
বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ;
স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব–
শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব?
নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট;
রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট।
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত;
তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি,
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।
তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে–
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।
Labels: ভাললাগে
১৯৪০
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।
অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো–
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো।
অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।
হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত–’রক্ত খরচ’ তাতে।
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!
১৯৪৬
বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ;
স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব–
শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব?
নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট;
রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট।
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত;
তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি,
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।
তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে–
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
Labels: Collections
দেখ, এই মোটা লোকটাকে দেখ
অভাব জানে না লোকটা,
যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে
লোভে জ্বলে তার চোখটা।
মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি
পাথরে তৈরি সব তার,
কত সুন্দর, পুরোনো এগুলো!
অট্রালিকা এ লোকটার।
উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে
চেয়ে দেখে না সে নীচুতে,
কত জামির যে মালিক লোকটা
বুঝবে না তুমি কিছুতে।
দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে
কলে আর কারখানাতে,
মেশিনের কপিকলের শব্দ
শোনো, সবাইকে জানাতে।
মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-
খেটে খেটে হল হন্যে ;
ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে
মোটা প্রভুটির জন্যে।
দেখ একজন মজুরকে দেখ
ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে,
কেনা গোলামের মতই খাটুনি
তাই হাড়ভাঙা খাটছে।
ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার
স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা,
এর সঙ্গে কি তুলনা করবে
প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা?
কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে
কাজ করে সারা বেলা এ,
পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-
বাকিটা পোষায় সেলায়ে।
তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,
থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল,
বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে
এমনি করেই কাটে কাল।
বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া
করে চোখে চোখে রাখে,
ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে
দোকানে যাওয়ার ফাঁকে।
খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা
ছুটে আসে পালে পাল,
খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর
হয়তো একটু ডাল।
কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে
খাদ্য কিনতে গিয়ে
দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,
বসে গালে হাত দিয়ে।
পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু
(সুতরাং চুপ; কথা বলবে না কভু)
সকলেরই প্রভু- ভালো আর খারাপের
তাঁরই ইচ্ছায় এ; চুপ করো সব ফের।
শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে,
চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে।
এদের কথায় ভরসা হয় না তবু?
সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু।
ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি,
আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি।
যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায়
পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায়।
মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত
এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত-
কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে।
সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে।
রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান্ দেশ,
যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ;
রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়,
লেনিন গড়েছে রাশিয়া! কী বিস্ময়!
রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী,
নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী,
সোভিয়েট-’তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো,
প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো।
মজুরের দেশ, কল-কারখানা,
প্রাসাদ, নগর, গ্রাম,
মজুরের খাওয়া মজুরের হাওয়া,
শুধু মজুরের নাম।
মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর
গরমে সাগর-ধার,
মজুরের কত স্বাধীনতা! আর
অজস্র অধিকার।
মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায়
জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে,
ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু
জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে।
মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয়
পাহারা দিন ও রাত,
গরীবের দেশে সইবে না তারা
বড়লোকদের হাত।
শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন
জীবন সেখানে, তাই
সকলেই সুখে বাস করে আর
সকলেই ভাই-ভাই;
এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা
বাঁচাতে মাতৃভূমি,
তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে,
আমার জন্যে তুমি।।
বিয়ে বাড়িঃ বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য
একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানা রকম খাদ্য;
হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ,
আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ,
বাসরঘরে সাজছে কনে, সকলে উৎফুল্ল,
লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুললঃ
“আসুন, আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,
যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য;
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি।
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।”
বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক,
আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক্-ধুক্,
‘হুলু’ দিতে তৈরী সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত,
সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত।
ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ;
হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দঃ
হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজলো জোরে,
বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে।
কোথায় বরের সাজসজ্জা? কোথায় ফুলের মালা?
সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা।
বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে।
বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে,
বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন?
পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন!
এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?
থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে?
কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে,
গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে।।
মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা;
‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘ দাস’ হলে ‘দাসা’
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- “সরা”।
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’
বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা।।
রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা,
হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা;
তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে,
রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে,
সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা-
দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা,
হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায়
ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়;
কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার,
আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার,
তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে,
ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে।
রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব?
ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব?
আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে-
যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে;
পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে,
নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।।
অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত
অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত।
মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত
হৃদয়গত।
ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে
দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।
এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত,
মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।
এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধন ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।
ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।
সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।
বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে
মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে,
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা!
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।
পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।
তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।
সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে -
দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা?
নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে
প্রগল্ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়।
-তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক?
স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু
প্রখর আলোর সীমা হতে
বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে।
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক।
গোপনে নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা?
মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল,
তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের।
প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন
আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে
চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়,
আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে
এসে পড়েছিল একদিন-
উদ্ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে
আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে
যত দূরে দৃষ্টি যায় -
চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা।
উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন
কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার,
-এই কি পৃথিবী?
একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় -
আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।।
ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু–
ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?
ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু,
পথে পথে বাস করি,
কখনো গাছের তলাতে
কখনো পর্ণকুটির গড়ি।
আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি,
হাজার জনতা যেখানে, সেখানে
আমি প্রতিদিন ঘুরি।
বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ,
তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব
মজবুত ইমারত।
বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না
তোমাদের দেওয়া ক্ষতে,
আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু
সূর্যোদয়ের পথে।
ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া,
রুশ ও চীনের কাছে,
আমার ঠিকানা বহুকাল ধ’রে
জেনো গচ্ছিত আছে।
আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো
সমস্ত দেশ জুড়ে?
তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ
ভুল পথে ঘুরে ঘুরে।
আমার হদিশ জীবনের পথে
মন্বন্তর থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।
বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই
সূর্যোদয়ের ভোরে;
পথ হারিও না আলোর আশায়
তুমি একা ভুল ক’রে।
বন্ধু, আজকে জানি অস্থির
রক্ত, নদীর জল,
নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল।
বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো
ঠিকানা অবজ্ঞাত
বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত?
আর কতদিন দুচক্ষু কচ্লাবে,
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই
ধর্মতলার পরে,
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।
বন্ধু, আজকে বিদায়!
দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।।
ভাল খাবার
ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত;
সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত
তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে
আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে।
সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা,
হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা।
সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর,
কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর।
এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ঘুটে,
টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে;
খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত,
খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত।
দিনরাত চিৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই,
আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই।
সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো,
খাওয়া ফেলে দিনরাত টাকা ব’লে চেঁচানো।
ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে;
চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে।
নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতিঃ
কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি?
নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক
দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক-ফিক্;
তারপর বললেনঃ বলা ভারি শক্ত
সবচেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত।
ভেজাল
ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা।’
ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা
ভেজাল কথা- বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।।
একটি মোরগের কাহিনী
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়–
আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত–
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।তারপর শুরু হল তাঁর আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা;
আর্শ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!তারপর এক সময় আঁস্তাকুড়েও এল অংশীদার–
ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতার মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে–
‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধব্ধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ;
অবশ্য খাবার খেতে নয়–
খাবার হিসেবে ।
কৃষকের গান
এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে
এইবার ফলাব ফসল–
আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে
আজ তার নির্জন বোধন।
এ মাটির গর্ভে আজ আমি
দেখেছি আসন্ন জন্মেরা
ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ
দুর্ভিরে অন্তিম কবর।
আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি?
(গোপন একান্ত এক পণ)
এ মাটিতে জন্ম দেব আমি
অগণিত পল্টন-ফসল।
ঘনায় ভাঙন দুই চোখে
ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে;
আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে
ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি।
দুয়ারে শত্রুর হানা
মুঠিতে আমার দুঃসাহস।
কর্ষিত মাটির পথে পথে
নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।
দেশলাই কাঠি
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ–
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন–
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন–
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে–
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছ বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে , গ্রামে–দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়–
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব–
সবাই শেষবারের মতো!
রানার
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে রানার!
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার–
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।রানার! রানার!
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্মিট্ ক’রে চায়!
কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!
কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে–
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠন্ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো।এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো দোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে–
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,–
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-
রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব’য়ে?
কি হবে ক্ষুদার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে–আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?রানার! গ্রামের রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে–
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি–
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।
সিঁড়ি
আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।তবুও আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না।
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।।
আঠারো বছর বয়স
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়–
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
Labels: ভাললাগে
- যে কোন একটা ফুলের নাম বল
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢোকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।
- কি করছো?
– ছবি আকঁছি।
- ওটা তো একটা বিন্দু।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই বৃত্ত হবে। কেন্দ্র হবে তুমি। আর আমি হবো বৃত্তাবর্ত।
- কিন্তু আমি যে বৃত্তে আবদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই অসীমের অধিকার।
– একটু অপেক্ষা করো। . . . এবার দেখো।
- ওটা কি? ওটা তো মেঘ।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই আকাশ হবে। তুমি হবে নি:সীম দিগন্ত। আর আমি হবো দিগন্তরেখা।
- কিন্তু সে তো অন্ধকার হলেই মিলিয়ে যাবে। আমি চিরন্তন হতে চাই।
– আচ্ছা, এবার দেখো।
- একি! এ তো জল।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই সাগর হবে। তিনভাগ জলের তুমি হবে জলকন্যা। আর আমি হবো জলাধার।
- আমার যে খন্ডিতে বিশ্বাস নেই। আমার দাবী সমগ্রের।
– একটু অপেক্ষা করো। এবার চোখ খোল।
- ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
– হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়। এবার বলো আর কি চাই তোমার?
- সারাজীবন শুধু ওখানেই থাকতে চাই।
-তুমি আজকাল বড় সিগারেট খাচ্ছ শুভঙ্কর
এখুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি ।
কিন্তু তার বদলে ?
বড্ড হ্যাংলা। যেন খাওনি কখনো?
-খেয়েছি।
কিন্তু আমার খিদের কাছে সে সব নস্যি।
কলকাতাকে এক খাবলায় চিবিয়ে খেতে পারি আমি।
আকাশটাকে মত ওমলেটের মত চিরে চিরে
নক্ষত্রগুলোকে চিনেবাদামের মত টুকটাক করে
পাহাড়গুলোকে পাঁপড় ভাজার মত মড়মড়িয়ে
আর গঙ্গা ?
সেতো এক গ্লাস শরবত।
-থাক। খুব বীর পুরুষ
-সত্যি তাই?
পৃথিবীর কাছে আমি এইরকমই ভয়ংকর বিস্ফোরণ।
কেবল তোমার কাছে এলেই দুধের বালক
কেবল তোমার কাছে এলেই ফুটপাথের নুলো ভিখারী
এক পয়সা, আধ পয়সা কিংবা এক পাউরুটির বেশী
আর কিছু ছিনিয়ে পারি না।
-মিথ্যুক।
-কেন?
-সেদিন আমার সর্বাঙ্গের শাড়ী ধরে টান মারোনি ?
-হতে পারে।
ভিখারীদের কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করে না একদিনও?
-তোমাদের ওখানে এখন লোডশেডিং কি রকম?
-বোলো না। দিন নেই, রাত নেই, জ্বালিয়ে মারছে।
-তুমি তখন কী করো?
-দরজা খুলে দিই
জানালা খুলে দিই
র্প দা খুলে দিই।
আজকাল হাওয়াও হয়েছে তেমনি ফন্দিবাজ ।
যেমনি অন্ধকার, অমনি মানুষের ত্রিসীমানা ছেড়ে দৌড়
-তুমি তখন কি করো?
-গায়ে জামা-কাপড় রাখতে পারি না।
সব খুলে দিই,
চোখের চশমা, চুলের বিনুনি, বুকের আঁচল লাজ-লজ্জ্বা সব ।
-টাকা থাকলে তোমার নামে ঘাট বাঁধিয়ে দিতুম কাশী মিত্তিরে
এমন তোমার উথাল - পাতল দয়া।
তুমি অন্ধকারকে সর্ বস্ব, সব অগি্নস্ফুলিঙ্গ খুলে দিত পার কত সহজে।
আর শুভঙ্কর মেঘের মত একটু ঝুঁকলেই
কি হচ্ছে কি?
শুভঙ্কর তার খিদে- তেষ্টার ডালপালা নাড়লেই
কি হচ্ছে কি ?
শুভঙ্কর রোদে - পোড়া হরিণের জিভ নাড়লেই
কি হচ্ছে কি?
পরের জন্মে দশদিগন্তের অন্ধকার হব আমি।
দেখতে মানুষ চামড়াধারী
নাকের ফুটো, দাঁতের মাড়ি,
কিন্তু বাপু হঠাত্ কেন মাথায় দুটো লম্বা শিং ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
শিং দিয়ে কি গুঁতোও নাকি ?
মেজাজ বুঝি আগুন খাকি ?
কিন্তু বাপু পানে সঙ্গে গিলছ কেন খাবলা হিং ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
বেশ তো দেখি হাসতে পারো
যক্ষা কাশি কাশতে পারো
কিন্তু বাপু লেখার সময় লিখছ কেন পিঁপড়ে ডিম ?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
লিখছ লেখ ভাবনাটা কই ?
চাইছ মুড়কি হচ্ছে যে খই,
কিন্তু বাপু বেচবে কাকে তোমার এসব ইড়িং বিং?
— আজ্ঞে আমি ফটিক টিং ।
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশরী বারংবার
আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলংকৃত করে ওষ্ঠতল।
আমি একা ফুটিতে পারি না।
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে একটি আরক্তিম কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
বহুজন্ম বসন্তের অম্লান মঞ্জুরী ফুটে আছো।
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুস্প বিচ্ছুরন।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।
তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর সম্ভারে
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদগত অশ্রু অভ্যথর্না করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যানে?
মোহিনীরা স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভালোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।
যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীন
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।
সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।
ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।
এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারলনা।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ ।
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন্ মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই ।
স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত থাকে গান, আলাপচারীতা ?
আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি, ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়, গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী ।
আকাঙ্খার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে ।
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর ।
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল কিছুতে বলবে না ।
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে এত ঘন বিশৃঙ্খলা কেন ?
রক্ত ঝরে না ভেজালে
কোনো সুখ দরজা খোলে না ।
ময়ূরও নাচে না তাকে দু-নম্বরী সেলামী না দিলে ।
হাতুড়ির ঘায়ে না ফাটালে
রাজার ভাঁড়ার থেকে এক মুঠু খুদ খেতে
পায় না চড়ুই ।
স্বপ্নে যারা পেয়ে গেছে সচেতন ফাউন্টেন পেন
তাদেরও কলমে দেখ
সূর্য কীরণের মত কোনো কালি নেই ।
হে স্তন্যদায়িনী
তোমার দুধের মধ্যে এত জল কেন ?
তোমার দুধের মধ্যে প্রতিশ্রুত ভাস্কর্যের পাথর কেবল ।
Labels: Collections
Labels: Collections
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভুক অমবস্যা এসে চলে গেল, কিন্তু সেই বোষ্টুমি আর এলো না
পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি ।
মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে !
নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁরে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে ?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে রাস উৎসব
অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পড়া ফর্সা রমণীরা কতরকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি !
বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন আমরাও...
বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স, সেই রাস উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না !
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ হবে !
ভালবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম
তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে কোন নারী !
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনা !
সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Labels: Collections
যে শিশু ভুমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম :
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে ।
খর্বদেহ নিঃসহায় তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্ব্যোধ্য প্রতিজ্ঞায় ।
সে ভাষা বুঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার ।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের--
পরিচয় পত্র পড়ি ভুমিষ্ঠ শিশুর,
অষ্পষ্ট কুয়াশা ভরা চোখে ।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের ।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি--
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস ।
সূকান্ত ভট্টাচার্য
Labels: Collections
সবচেয়ে যে ছোট পিড়ি খানি
সেখানি আর কেউ রাখেনা পেতে,
ছোটথালায় হয় নাকো ভাতবাড়া
জল ভরে না ছোট্ট গেলাসেতে ।
বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট
খাবার বেলা কেউ ডাকে না তাকে ।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল,
তারই খাওয়া ঘুচেছে সব আগে ।
সবচেয়ে যে অল্পে ছিল খুশি,
খুশি ছিল ঘেষাঘেষির ঘরে,
সেই গেছে হায়, হাওয়ার সঙ্গে মিশে,
দিয়ে গেছে জায়গা খালি করে ।
ছেড়ে গেছে পুতুল, পুঁতির মালা,
ছেড়ে গেছে মায়ের কোলের দাবি ।
ভয়ভরা সে ছিল যে সব চেয়ে
সেই খুলেছে আঁধার ঘরের চাবি ।
হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে ওরে !
হারিয়ে গেছে 'বোল' বলা সেই বাঁশি
দুধে ধোওয়া কচি সে মুখখানি
আঁচল খুলে হঠাৎ স্রোতের জলে
ভেসে গেছে শিউলী ফুলের রাশি ,
ঢুকেছে হায় শশ্মান ঘরের মাঝে
ঘর ছেড়ে হায় হৃদয় শশ্মানবাসী ।
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে ।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে ।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে ।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
Labels: ভাললাগে
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।'
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
নির্মলেন্দু গুণ
Labels: ভাললাগে
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার , মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন ।
জীবনানন্দ দাশ
Labels: Collections
হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে ।
পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে ;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদন জাগাতে ভালোবাসে !
হায় চিল , সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !
জীবনানন্দ দাশ
Labels: Collections
শিশুরা খেলাঘর করে ।
তারা হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন নিয়ে
বড়দের মতো সংসার সংসার খেলে ।
তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
ঘুমভাঙ্গার পর শুরু হয় তাদের অন্যখেলা ।
এক্কা-দোক্কা, গোল্লাছুট কিংবা
কানামাছি ভোঁ ভোঁ !
বড়োরাও খেলাঘর করে ।
তাদের বাসন-কোসনগুলো আকৃতিতে বড়ো,
তাদের কামনা বাসনার মতো ।
তারা তাদের খেলাঘরের নাম রাখে সংসার ।
শিশুদের মতো তারাও ক্লান্ত হয় ,
তারাও সংসার ভাঙ্গে, কিন্তু শিশুদের মতো
তারা ঘুমুতে পারে না ।
নির্মলেন্দু গুণ
Labels: Collections
Labels: ভাললাগে
Labels: ভাললাগে
Copyright 2009 -
Small journey
Blogspot Theme Design by: Ray Creations, HostingITrust.com Tested by Blogger Templates