চারিদিকে নির্বাচনের যুদ্ধ যুদ্ধ চলছে ; তাও আবার বিজয়ের মাসে। ডিসেম্বর এলেই আমাদের মনের বাগানে স্বদেশ প্রেমের ফুলগুলো বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি বিকশিত হয়, একটু বেশি গন্ধ ছড়ায়, একটু বেশি কাঁপন তোলে। জননী জন্মভূমি আরো বেশি করে মনে করিয়ে দেয় আমাদের করণীয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এ ব্যাপারে যেন একটু বেশিই সজাগ। হতেই হবে । পরিবর্তন তো তাদের হাত ধরেই আসবে। এই সব সীমিত ক্ষমতার অধিকারী নতুন প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি সবসময়ই চেষ্টায় থাকি আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে। বলতে যদিও লজ্জা লাগছে, মনে হচ্ছে নিজের প্রচার-প্রসার ঘটাচ্ছি। তারপরও বলি। কারণ এটুকু না বললে সবটা বোঝানো যাবেনা। আমি ক্ষুদ্রতায় বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, ছোট ছোট ঢেউগুলোকে জুড়ে দিলেই সুনামীর জন্ম হতে পারে।তাই যখনই সুযোগ পাই আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা'কে কাজে লাগাতে চেষ্টা করি মানুষের কল্যাণে। একটা জীবন, একটা দিন, অথবা একটা ঘন্টা অথবা একটা মূর্হুত। আমি ডাক্তার নই, সমাজ কর্মী নই, মিডিয়ার বাঘা কেউ নই। তারপরও চেষ্টা করে যাই প্রতিনিয়ত সচেতনতার বীজবুনে দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে। কারণ আমাদের মায়েরা এখনো তাদের সন্তানের কপালে কাজলের টিপ দেন নজর লাগবে বলে। আমরা এখনো নখ কাটতে ভুলে যাই, মাঠ থেকে ফিরে হাত না ধুয়েই হয়তো খাবারে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ফসলের ক্ষেতে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সদ্য ফুলে ফেঁপে ওঠা শসার গায়ে কামড় বসাই ধোয়ার তোয়াক্কা না করেই। এখনো আমাদের শিশুরা খোলা ময়দানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়, পুকুরের পানি না হলে এখনো অনেকের ডাল সেদ্ধ হয়না। এই তো আমাদের সবুজ বাংলাদেশ। এখনো আমরা ঠিক সচেতন হতে পারিনি। যাইহোক, সুযোগ পেলেই আমি আমার এই সব জ্ঞানের তাবিজ লোকের মাঝে বিলি করি। তারই রেশ ধরে আজকে আমার গৃহদ্বারে একজন আদিম বাঙ্গালীর আগমন। আদিম বলছি একারণেই তার বেশভূষা, চেহারা , আচরণ সবখানেই বন্যতা। খালি পায়ে ঠান্ডা লাগে, একজোড়া সেন্ডেলের প্রয়োজন। দিলাম একজোড়া পুরনো সেন্ডেল। ভাল করে চেয়ে দেখি হাত-পায়ে বেড়ে উঠেছে নখের কোদাল। তারই ধারালো ফলায় জমে আছে বাংলার ধূসর মাটি। স্যান্ডেল জোড়া বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম " নখ কাটেন না কেন?" উত্তর এলো সে নিজের নখ নিজে কাটতে পারেনা। কেউ একজন কেটে দিত কিন্তু সে কিছুদিন ধরে আসছে না। ভাল করে চেয়ে দেখলাম আসলেই তাই। বয়সের ভারে ম্রিয়মান, চলার সামর্থ্যটুকুও হারাতে বসেছে। আমার কাছে একটা পুরনো ব্লেড চাইলো, তাও দিলাম। যে করেই হোক নখ আজকে কাটাতেই হবে। কিন্তু বিধিবাম, একটা আঙুলের নখ অর্ধেক কাটতে না কাটতেই হাত কেটে ফেলার উপক্রম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। মিশন ফেল হতে চলেছে। আমার তিন সঙ্গী (একজনের বয়স ৯, একজনের ৪ এবং একজনের ৩) অবাক চোখে তাদের লিডারের দিকে চেয়ে আছে। এই তিন পিচ্চির মাঝে আমি সুস্থ জীবনের বীজ বপনের চেষ্টায় আছি। খেলতে খেলতে নতুন নতুন বিষয় শেখানো, লেখাপড়া, গান, ছড়া, ছবি আঁকা সবকিছু খেলার ছলে শেখানোর একটা প্রচেষ্টা। এমনকি খাবার আগে হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সহযোগীতা এমনকি মানুষকে সহযোগীতার লেটেস্ট ফর্মূলা পর্যন্ত তাদের খেল্যপুস্তকের সিলেবাস। সবচেয়ে ছোট পিচ্চিটা ভিক্ষুক দেখলেই বলে" চাল নেবেন?" যাইহোক, ভবিষ্যতের এই তিন ক্ষুদে উত্তরসূরীর সামনে নিজের প্রেস্টিজ বাঁচাতে কোমর বেঁধে মাঠে নামলাম। চারপাশে লোকজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে আর আমি ফকিরের নখ কাটায় ব্যস্ত। কাকের মত চোখ বুঁজে আছি আর কি। যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মোবাইলে একটা ছবিও তুলে রাখলাম। অনুপ্রেরণার জন্য। লোকটা খুশিই হলো। একসময় গল্পে গল্পে জিজ্ঞেস করলাম" '৭১ এ তো জোয়ান ছিলেন, কি করেছিলেন? লোকটা উত্তর দিল " রাজাকার ছিলাম" । হাতটা থেমে যেতে চাইলো। কোন মতে কষ্টে-সৃষ্টে নখগুলো কেটে দিলাম। যাবার সময় লোকটা জানতে চাইলো আবার কবে আসবে। আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম" আর কখনোই এ পথে আসবেন না। আপনারাই তো বাংলাদেশের বারোটা বাজিয়েছেন, এই হাত দিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছেন আমার মত অসংখ্য নারীদের। তারপর থেকে সারাদিনই আমার অস্থির লাগছে। আঙুল গুলো ঘৃণায় কেঁপে উঠছে। নিঘূর্ম চোখে বার বার মনে হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে আমি কাকে সাহায্য করলাম?
২২শে ডিসেম্বর, ২০০৯
সৌম্য বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০০:৩২:৫৬
সজল শর্মা বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০১:১৮:১৫
একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করেছেন- সেটা মানবতা, আর রাজাকার হিসেবে তাকে ঘৃণা করেছেন সেটা দেশপ্রেম- শহীদদের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই ঘটনা ছিল আপনার জন্য ধর্ম সংকট- যাই হোক, আপনি মানবতা ও দেশপ্রেম, দুটি পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন।
জাকির বেপারী বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০২:০৯:২০
একমত
আঁধার বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০১:৩২:২০
ধন্যবাদ দুজনকেই। সজল'দা কি বলবো ...এখনো দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আঙুলগুলো থেকে থেকে কাঁপছে। তারপরও আপনার মন্তব্য দেখে মন অনেকটাই ভাল হয়ে গেছে। আশা করি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে.........
আজব ঢাকা বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০১:৩৭:৫৯
ভালো লাগলো..................
ইয়াহইয়া ফজল বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ০৩:২৪:০৪
আপনি তো আর রাজাকারের হাতের নখ কেটে দেননি। আর আগে রাজাকার জানলে কি আর এই কাজ করতেন। এইখানে আপনার কোন দোষ নাই। বরং আপনি আমাদের তথাকতিত সামাজিক দেয়াল ডিঙ্গিয়ে একজন বৃদ্ধকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেটাই আপনার মহত্ব।
যাক্। আপনার লিখা খুব ভাল লাগল। তাই প্রোফাইলটা পড়তে গেলাম। এবং হতাশ হলাম। এখানে অল্প হলেও কিছু লেখা থাকা উচিত ছিল। অন্তত গদ্যে যার হাত এত ভালো তার তো বটেই। দাবী থাকলো পরবর্তী পোস্ট যখন পড়ব আপনার তখন প্রোফাইলে চোখ বুলালে যেন কিছু চোখে পড়ে। ভাল থাকবেন।
০০১ বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ১১:৪৩:১৭
নাড়া খেয়েছি। আমি হলে কি করতাম, তা-ই ভাবছি।
আপনার জন্য শুভকামন।
আঁধার বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ২২:৫৪:১৩
ফজল ভাই কাল যে আমার কি হয়েছিল তা শুধু আমিই জানি। সারাটা শরীরে ঘৃণা যেন ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছিল।ফেলে দেয়া নখ গুলো এমনকি যে সাবানটা দিয়ে আমি হাত ধুয়েছি সেটার দিকে তাকাতেও চোখ বুজে যাচ্ছিল। ভূমিকম্পের মত কাঁপতে কাঁপতে লেখাটা পোস্ট করেছি, নিজের প্রোফাইলের দিকে তাকানোর মত মানসিকতাও ছিলনা। তাছাড়া পরিচয় দেবার মত যোগ্যতা আমি এখনো অর্জন করতে পারিনি। শুধু আজ এটুকু বলে যাই, শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্বলিত কিছু নথিপত্র আমার আছে কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটাবার সৌভাগ্য আমার এখনো হয়নি। জানিনা কখনো হবে কিনা। তবুও অপেক্ষায় আছি নতুন ভোর দেখবো বলে...
আঁধার বলেছেন ২০০৮/১২/২২ ২২:৫৬:১৫
সবাই কে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গেছি, ঘোর মনে হচ্ছে এখনো কাটেনি যাইহোক, ধন্যবাদ সবাইকে