Small journey

ছোট ছোট ঢেউ জুড়েই সুনামীর সৃষ্টি হয়

সুকান্ত ভট্টাচার্য

পৃথিবীর দিকে তাকাও

দেখ, এই মোটা লোকটাকে দেখ
অভাব জানে না লোকটা,
যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে
লোভে জ্বলে তার চোখটা।
মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি
পাথরে তৈরি সব তার,
কত সুন্দর, পুরোনো এগুলো!
অট্রালিকা এ লোকটার।
উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে
চেয়ে দেখে না সে নীচুতে,
কত জামির যে মালিক লোকটা
বুঝবে না তুমি কিছুতে।
দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে
কলে আর কারখানাতে,
মেশিনের কপিকলের শব্দ
শোনো, সবাইকে জানাতে।
মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-
খেটে খেটে হল হন্যে ;
ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে
মোটা প্রভুটির জন্যে।
দেখ একজন মজুরকে দেখ
ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে,
কেনা গোলামের মতই খাটুনি
তাই হাড়ভাঙা খাটছে।
ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার
স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা,
এর সঙ্গে কি তুলনা করবে
প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা?
কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে
কাজ করে সারা বেলা এ,
পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-
বাকিটা পোষায় সেলায়ে।
তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,
থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল,
বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে
এমনি করেই কাটে কাল।
বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া
করে চোখে চোখে রাখে,
ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে
দোকানে যাওয়ার ফাঁকে।
খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা
ছুটে আসে পালে পাল,
খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর
হয়তো একটু ডাল।
কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে
খাদ্য কিনতে গিয়ে
দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,
বসে গালে হাত দিয়ে।
পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু
(সুতরাং চুপ; কথা বলবে না কভু)
সকলেরই প্রভু- ভালো আর খারাপের
তাঁরই ইচ্ছায় এ; চুপ করো সব ফের।
শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে,
চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে।
এদের কথায় ভরসা হয় না তবু?
সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু।
ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি,
আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি।
যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায়
পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায়।
মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত
এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত-
কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে।
সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে।
রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান্ দেশ,
যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ;
রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়,
লেনিন গড়েছে রাশিয়া! কী বিস্ময়!
রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী,
নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী,
সোভিয়েট-’তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো,
প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভালো।
মজুরের দেশ, কল-কারখানা,
প্রাসাদ, নগর, গ্রাম,
মজুরের খাওয়া মজুরের হাওয়া,
শুধু মজুরের নাম।
মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর
গরমে সাগর-ধার,
মজুরের কত স্বাধীনতা! আর
অজস্র অধিকার।
মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায়
জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে,
ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু
জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে।
মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয়
পাহারা দিন ও রাত,
গরীবের দেশে সইবে না তারা
বড়লোকদের হাত।
শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন
জীবন সেখানে, তাই
সকলেই সুখে বাস করে আর
সকলেই ভাই-ভাই;
এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা
বাঁচাতে মাতৃভূমি,
তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে,
আমার জন্যে তুমি।।


বিয়ে বাড়ির মজা

বিয়ে বাড়িঃ বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য
একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানা রকম খাদ্য;
হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ,
আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ,
বাসরঘরে সাজছে কনে, সকলে উৎফুল্ল,
লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুললঃ
“আসুন, আসুন-বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,
যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য;
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি।
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।”
বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক,
আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক্-ধুক্,
‘হুলু’ দিতে তৈরী সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত,
সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত।
ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ;
হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দঃ
হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজলো জোরে,
বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে।
কোথায় বরের সাজসজ্জা? কোথায় ফুলের মালা?
সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা।
বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে।
বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে,
বললে পুলিশঃ এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন?
পঞ্চাশ জন কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন!
এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?
থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে?
কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে,
গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে।।


মেয়েদের পদবী

মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা;
‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘ দাস’ হলে ‘দাসা’
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- “সরা”।
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’
বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা।।


রেশন কার্ড

রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা,
হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা;
তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে,
রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে,
সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা-
দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা,
হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায়
ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়;
কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার,
আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার,
তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে,
ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে।
রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব?
ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব?
আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে-
যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে;
পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে,
নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।।


অসহ্য দিন

অসহ্য দিন! স্নায়ু উদ্বেল। শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত
অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত।
মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত
হৃদয়গত।
ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে
দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।
এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সমুদ্যত,
মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত।।


রৌদ্রের গান

এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধন ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।
ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।

সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।

বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে
মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে,
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা!
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।

পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।

তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।

সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।


আসন্ন আঁধারে

নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে -
দুনিয়ায় ক্লান্তি আজ কোথা?
নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে
প্রগল্‌ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায়।
-তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক?
স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দুটুকু
প্রখর আলোর সীমা হতে
বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে।
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক।
গোপনে নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা?
মেরুদণ্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ, -মুমূর্ষু চঞ্চল,
তবুও বিরাম কোথা ব্যগ্র আঘাতের।

প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন
আবাল্যের সঞ্চিক দাহনে
চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায়,
আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে
এসে পড়েছিল একদিন-
উদ্‌ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে
আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দুরে- বহু দূরে
যত দূরে দৃষ্টি যায় -
চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা।
উড়ন্ত বাতাসে আজ কুমেরু কঠিন
কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার,
-এই কি পৃথিবী?
একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায় -
আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড়।।


ঠিকানা

ঠিকানা আমার চেয়েছ বন্ধু–
ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাও নি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান?
ঠিকানা না হয় না নিলে বন্ধু,
পথে পথে বাস করি,
কখনো গাছের তলাতে
কখনো পর্ণকুটির গড়ি।
আমি যাযাবর, কুড়াই পথের নুড়ি,
হাজার জনতা যেখানে, সেখানে
আমি প্রতিদিন ঘুরি।
বন্ধু, ঘরের খুঁজে পাই নাকো পথ,
তাইতো পথের নুড়িতে গড়ব
মজবুত ইমারত।

বন্ধু, আজকে আঘাত দিও না
তোমাদের দেওয়া ক্ষতে,
আমার ঠিকানা খোঁজ ক’রো শুধু
সূর্যোদয়ের পথে।
ইন্দোনেশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া,
রুশ ও চীনের কাছে,
আমার ঠিকানা বহুকাল ধ’রে
জেনো গচ্ছিত আছে।
আমাকে কি তুমি খুঁজেছ কখনো
সমস্ত দেশ জুড়ে?
তবুও পাও নি? তাহলে ফিরেছ
ভুল পথে ঘুরে ঘুরে।
আমার হদিশ জীবনের পথে
মন্বন্তর থেকে
ঘুরে গিয়েছে যে কিছু দূর গিয়ে
মুক্তির পথে বেঁকে।
বন্ধু, কুয়াশা, সাবধান এই
সূর্যোদয়ের ভোরে;
পথ হারিও না আলোর আশায়
তুমি একা ভুল ক’রে।
বন্ধু, আজকে জানি অস্থির
রক্ত, নদীর জল,
নীড়ে পাখি আর সমুদ্র চঞ্চল।
বন্ধু, সময় হয়েছে এখনো
ঠিকানা অবজ্ঞাত
বন্ধু, তোমার ভুল হয় কেন এত?
আর কতদিন দুচক্ষু কচ্‌লাবে,
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধ’রে ভাই
ধর্মতলার পরে,
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
ক্ষুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।
বন্ধু, আজকে বিদায়!
দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।।


ভাল খাবার

ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত;
সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত
তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে
আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে।
সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা,
হাজার সেলাম পান দিনে গড়পড়তা।
সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর,
কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই-খাই’ বাই তাঁর।
এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ঘুটে,
টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে;
খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত,
খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত।
দিনরাত চিৎকারঃ আরো বেশি টাকা চাই,
আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই।
সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো,
খাওয়া ফেলে দিনরাত টাকা ব’লে চেঁচানো।
ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে;
চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে।
নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতিঃ
কী খাদ্য চাই? কী সে খেতে উত্তম অতি?
নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক
দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক-ফিক্;
তারপর বললেনঃ বলা ভারি শক্ত
সবচেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত।


ভেজাল

ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হায় ফয়দা।’
ভেজাল পোষাক, ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা
ভেজাল কথা- বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।।



একটি মোরগের কাহিনী

একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়–
আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত–
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।

তারপর শুরু হল তাঁর আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা;
আর্শ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!

তারপর এক সময় আঁস্তাকুড়েও এল অংশীদার–
ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতার মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।

খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে–
‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!

তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধব্‌ধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ;
অবশ্য খাবার খেতে নয়–
খাবার হিসেবে ।


কৃষকের গান

এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে
এইবার ফলাব ফসল–
আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে
আজ তার নির্জন বোধন।
এ মাটির গর্ভে আজ আমি
দেখেছি আসন্ন জন্মেরা
ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ
দুর্ভিরে অন্তিম কবর।
আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি?
(গোপন একান্ত এক পণ)
এ মাটিতে জন্ম দেব আমি
অগণিত পল্টন-ফসল।
ঘনায় ভাঙন দুই চোখে
ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে;
আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে
ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি।
দুয়ারে শত্রুর হানা
মুঠিতে আমার দুঃসাহস।
কর্ষিত মাটির পথে পথে
নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।


দেশলাই কাঠি

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি নাঃ
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ–
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।

মনে আছে সেদিন হুলস্থূল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন–
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই- ছোট্ট একটা দেশলাই কাঠি।

এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন–
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে–
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।

আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছ বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে , গ্রামে–দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়–
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব–
সবাই শেষবারের মতো!


রানার

রানার ছুটেছে তাই ঝুম্‌ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে, খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে রানার!
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার–
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

রানার! রানার!
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে,আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ- বুঝি হয় লাল ও-পূর্বকোণ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্‌মিট্ ক’রে চায়!
কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!
কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে–
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠন্‌ঠন্, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ, রানার! এখনো রাতের কালো।

এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে।

রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো দোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে–
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,–
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-
রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব’য়ে?
কি হবে ক্ষুদার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে–আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?

রানার! গ্রামের রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে–
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি–
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার।।


সিঁড়ি

আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।

তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।

তবুও আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না।
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।।


আঠারো বছর বয়স

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।

আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।

তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়–
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।

1 comments:

Nullblogger May 17, 2022 at 10:46 AM  

https://www.nullblogger.com/2022/02/wordpress-introduction-nullblogger.html

Me

Me

About this blog

Hello

This is Fahmida. You may imagine me as a five feet white ball. Completed MBA in Management . ভাললাগে গ্রাফিক্সের টুকিটাকি। শখ ছিল ফটোগ্রাফার হবো কিংবা সাংবাদিক। হইনি কিছুই। পেশায় ব্যাংকার। জন্ম উত্তর বঙ্গে। বসবাস দক্ষিণে। মাঝে মাঝে এক আধটু প্যাঁচাই। যদিও আমার লেখালেখির হাতেখড়ি আপ্র (http://forum.amaderprojukti.com/memberlist.php?mode=viewprofile&u=1094) থেকে তারপরও মাঝে মাঝে প্রথম আলো ব্লগেও মাঝেমাঝে ঢুঁ মারি। নিক আঁধার http://prothom-aloblog.com/users/base/adhar/p1 । আজকাল সচলদের অতিথি হতে ভাল লাগে। নিক অমাবস্যা। ইদানীং টিউরোটিয়াল বিডি'তে লেখার চেষ্টা করছি। গান শোনা, কবিতা পড়তে ভালবাসি। ভালবাসি ব্লাক কফি আর সিলেটের চা-পাতা । এক কথায় Im busy for nothing :)


লাইসেন্স:Licence
by-nc-nd (Creative Commons)

Blog Archive

My Blog List